লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট
মহাকাশ যুগে বাংলাদেশের গৌরবময় প্রবেশ
আকাশ আমায় ভরলো আলোয়, আকাশ আমি ভরবো গানে। কবির ভাষায়- গ্রহ-নক্ষত্র দিয়ে আকাশ আমাদের আলোয় আলোয় ভরে দিয়েছে। আর সেই আলোয় আলোকিত মানুষ তাদের জ্ঞান ও সৃজনশীলতা দিয়ে মহাকাশকে গানে, ছবিতে ও তথ্যে ভরপুর করছে। আকাশস্থ যোগাযোগ উপগ্রহ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে টেলিভিশনের পর্দায় আমরাও তা উপভোগ করি। কিন্তু বিদেশী স্যাটেলাইট থেকে চ্যানেল ভাড়া করে তবেই তা সম্প্রচারিত হয়। তবে আশার কথা বেতার তরঙ্গের মতো এবার মহাকাশে উড়তে যাচ্ছে আমাদের স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। এই কৃত্রিম উপগ্রহ স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ভি-স্যাট ও বেতারসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দেবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ট্যারিস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা বহাল থাকা, পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ই-সেবা নিশ্চিত করবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট।
মহাকাশে উৎক্ষেপণের অপেক্ষায় আমাদের এই জিও স্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূ-স্থির উপগ্রহ। এই উপগ্রহ স্থাপন রূপকল্পের সাথে শুরু থেকেই অংশীদার ছিলেন বেতার সম্প্রচারর বিশেষজ্ঞ মনোরঞ্জন দাস। বর্তমানে তিনি এবিসি রেডিও’র উপদেষ্টা। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন উদযাপনের আগ মুহূর্তে এই স্যাটেলাইটের সুবিধা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ডিজিটাল ডিভাইড দূর করতে সবচেয়ে অধিকতর কার্যকারী হবে বঙ্গবন্ধু-১। বর্তমানে আমাদের দেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অন্যদেশের স্যাটেলাইট থেকে যে কানেকটিভিটি কিনে ব্যবহার করছে। সেখানে এই স্যাটেলাইটটি সাশ্রয়ী হবে। দুর্গম অঞ্চলে সাশ্রয়ী কানেক্টিভিটি নিশ্চিতসহ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বাধিক ভূমিকা রাখবে। ডিটিইএচ বা বিনোদনের ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হবে। তবে এর সবটাই নির্ভর করবে এর জন্য গঠিত কোম্পানির পরিচলনা কর্তৃপক্ষের ওপর। বিস্তারিত জানাচ্ছেন- ইমদাদুল হক।
প্রশ্ন: একজন সম্প্রচার বিশেষজ্ঞ ও যোগাযোগ উপগ্রহ বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রথমেই জানতে চাই, যোগাযোগ উপগ্রহগুলোর অবস্থানও এগুলো আমাদের কী কাজে লাগে?
উত্তর:প্রথমেই বিনীতভাবে বলতে চাই আমি কোন বড় বেতার সম্প্রচার বিশেষজ্ঞ নই, বেতার সম্প্রচারের সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ বৎসর যাবৎ আছি এই যা। আর যোগাযোগ উপগ্রহের বিশেষজ্ঞ তো এটাই। আমাদের নিজস্ব উপগ্রহ থাকার বিষয়ে আমি আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করতে পেরেছিলাম। যোগ্যস্থানে, এইটুকুই বলতে পারি। বর্তমানে আকশ সংস্কৃতি শব্দের সাথে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। স্যাটেলাইট টিভি ও রেডিও থেকে সম্প্রচারিত সব অনুষ্ঠানই কিন্তু এই যোগাযোগ উপগ্রহ হয়ে আসে। এছাড়া যোগাযোগ উপগ্রহ দিয়ে ইন্টারনেট, টেলিফোনের সমস্ত যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানের কিছু পর্যবেক্ষণও সেখানে রাখা যায়। কাজের বিবেচনায় যোগাযোগ উপগ্রহ তিন ধরনের হয়ে থাকে। জিও স্টেশনারি স্যাটেলাইট, লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট (লিও) এবং মিডিয়াম আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট (মিও)। মিও স্যাটেলাইট ভূ-স্থির স্যাটেলাইট থেকে পৃথিবীর নিচু কক্ষপথে পৃথিবীকেপ্রদক্ষিণ করে। এখন টেলিযোগাযোগে মিও স্যাটেলাইট ব্যবহার হয় না। পৃথিবীর ১৮,০০০ কি.মি. উচ্চতার কক্ষপথে ভ্রমণরত ২৪ টি জিপিএস বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম মিও স্যাটেলাইটের দৃষ্টান্ত। লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০০০ থেকে ২৫০০ শত কি.মি. উচ্চতার কক্ষপথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। এদের আবর্তন বেগ বেশি হয়। সাধারণত এদের ঘূর্ণনকাল প্রায় ৯০ মিনিট।
প্র্রশ্ন: আগামী ৭ মে থেকে কক্ষপথে বিচরণ করতে যাচ্ছে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’। এটি তো জিও স্টেশনারি স্যাটেলাইট। জিও স্যাটেলাইট কী?
উত্তর: জিও স্টেশনারি স্যাটেলাইটই মূলত প্রধান যোগাযোগ উপগ্রহ। পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রেক্ষিতেএই উপগ্রহের অবস্থান সবসময় স্থির থাকে। তাই একে বাংলায় ভূ-স্থির উপগ্রহ বলা হয়। তবে এটি কিন্তু বাস্তবে স্থির নয়। এটি পৃথিবীর সাথে সাথে ঘুরে প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার ওপর থেকে। যদিও স্যাটেলাইটটি কক্ষপথে আবর্তনশীল থাকবে কিন্তু সেটি পৃথিবী পৃষ্ঠের যে কোনো স্থানের প্রেক্ষিতে স্থিরই থাকবে, যেমনটা ভূ-স্থির উপগ্রহ বা জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট থাকে এবং থাকছে। কারণ পৃথিবী যতক্ষণে নিজ অক্ষে একবার ঘুরবে ঠিক ততক্ষণে সে স্যাটেলাইটও বিষুব রেখা বরাবর বা বিষুব রেখার সমন্তরালে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে একবার পৃথিবীকেই আবর্তন করবে। তাই স্যাটেলাইটটি ঠিক বিচরণ করছে বা করবে এমনটা বলা যথার্থ হবে না।
প্রশ্ন: দীর্ঘ দিন ধরেইতো বাংলাদেশে স্যাটেলাইট সম্প্রচার চলছে। কিন্তু কক্ষপথে নিজেদের স্যাটেলাইট স্থাপনে এতো সময় লাগলো কেন?
উত্তর: এক কথায় বললে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিশেষ করে উচ্চমহলের দূরদর্শীতার অভাবে। সবমিলিয়েরাজনৈতিক অস্থিরতা ও পটপরিবর্তন এই বিলম্বেরঅন্যতম কারণ বলা যেতে পারে।
প্রশ্ন: কখন বা কীভাবে বাংলাদেশের জন্য জিও স্যাটেলাইট স্থাপনের কাজ শুরু হলো?
১৯৭৫ সালেই কিন্তু জেনেভায় অনুষ্ঠিত আইটিইউ সম্মেলনে গিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইটের জন্য ¯øট প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ বেতারের প্রধান প্রকৌশলী বিএম অধিকারী। বাংলাদেশের জন্য অনেকটা সুবিধাজনক অরবিটাল লোকেশন ৭৪ ডিগ্রী (পূর্ব) তখন পাওয়া গিয়েছিল। এর পর আর কোন উদ্যোগই হয়নি; বিষয়টা একদম বিস্মৃতিতে তলিয়ে গেছে, এখন মনে হচ্ছিল। অনেক পরে ওই সূত্রটির বরাত দিয়ে১৯৯৭ সালের দিকে বন্ধুত্বের সুবাদে আমি তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে বাংলাদেশের জন্য একটি নিজস্ব স্যাটেলাইটের প্রয়োজনীয়তার কথা বলি। সচিব পদার্থবিদ ফজলুর রহমান তার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জেনারেল নুরুদ্দীন খানের সাথে আলাপ করেন। দু’জনের আগ্রহেই এই স্বপ্নটি একটি আকার পেতে থাকে। এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত হন স্পারসো চেয়ারম্যান ড. এ এম চৌধুরী। ১৯৯৮ সাল। তখন বাংলাদেশে জাপানের একটি প্রতিনিধি দল আসে। মন্ত্রী মহদোয় তাদের কাছে প্রস্তাব দিলে আর্থিক সহযোগিতাসহ তারা আমাদের এ কাজে সহায়তার আশ^াস দেন। কিন্তু দেশে ফিরে গিয়ে ওই প্রতিনিধি দল জানান, আইন ও নীতিগত কারণে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান স্পারসো’র সাথে জাপান কাজ করতে পারবে না। কিন্তু এতে দমে যাননি তদানীন্তন দূরদর্শী প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সিদ্ধান্ত দেন যে, বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নেই এ প্রয়োজনীয় প্রকল্পের বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পের নাম দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট।কিন্তু২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায়। এরই মধ্যে শুরু হয় তত্ত¡াবধায় সরকারের আমল। ওই সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি মনোনীত হন আমার পরিচিত মানিক লাল সমাদ্দার। তাকে আমি প্রকল্পটির পূনর্জীবনে কথা বললে তিনি পরামর্শ দেন অধিকতর অর্থ অর্জনকারী মন্ত্রণালয় টেলিকমিউনিকেশন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে। তখনআমি রেডিও টুডে’র উপদেষ্টা। কর্মসূত্রেবিটিআরসির প্রাক্তন কমিশনার মেজর জেনারেল মঞ্জুরুল আলমের সাথে আমার পরিচয় ও সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিল। তাঁকে আমি স্যাটেলাইট প্রকল্পের বিষয়টা বলি। তিনি সাগ্রহে ইতিবাচক সাড়া দেন এবং প্রকল্পটি পুনর্জীবনের জোরালো পদক্ষেপ নেন। এরপর ২০০৯ সালে পুনরায় দূরদর্শী শেখ হাসিনার সরকার অধিষ্ঠিত হলে প্রকল্পটি সত্যিকারের নবশক্তি, নববেগ লাভ করে। এ পর্যায়ে মন্ত্রণালয়ে দু’জন মন্ত্রী প্রথমে রাজিউদ্দিন রাজু এবং পরে তারানা হালিম, বিশেষভাবে, যোগ্য ভূমিকা রাখেন। এছাড়া বিটিআরসির কর্মকর্তাগণ যথেষ্ট শ্রম দিয়ে একে বর্তমান চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দেন এ প্রকল্পটিকে। এদের মধ্যে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ, কমিশনার (পরে সিনিয়র কনসালটেন্ট) মল্লিক সুধীর চন্দ্র এবং প্রকল্প পরিচালকদ্বয় গোলাম রাজ্জাক ও মেজবাহুজ্জামানের নাম উল্লেখ করতে হয়।
প্রশ্ন: এতোদিন তো আমরা পরের উপগ্রহ ব্যবহার করতাম। এবার নিজেদের উপগ্রহ হচ্ছে। কেমন লাগছে?
উত্তর:মহাবিশ্ব-মহাকাশ অভিযানেশুধু ধনী ও প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর দেশ নয় বরং প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া দেশও অংশ নিচ্ছে এই মহাযজ্ঞে। কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তো সীমান্ত নেই। আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ ও সহযোগিতায় পৃথিবীর নানা দেশ যৌথভাবে এখন মহাকাশ অভিযানে অংশ নিচ্ছে। মঙ্গলগ্রহে প্রেরণ করছে মনুষ্যহীন মহাকাশযান। নিকট ভবিষ্যতে মঙ্গলপৃষ্ঠে পদচিহ্ন রাখবে মানুষ। লাল ওই গ্রহ হতে পারে মানবজাতির দ্বিতীয় আবাসভূমি। শনিগ্রহের উপগ্রহ টাইটানে জীবনের সন্ধান করছেন বিজ্ঞানীরা। বসবাসেরও স্বপ্ন দেখছেন ও দেখাচ্ছেন। মিশন প্রেরণ করা হয়েছে বামনগ্রহ প্লুটোতে-এমনকি সৌরজগতের বাইরে মহাবিশ্বের হ্যাবিটেবল জোনে। বাংলাদেশও মহাজাগতিক এই কর্মযজ্ঞে যুক্ত হতে যাচ্ছে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে। আর এটি হচ্ছে, সৌরজগৎ ও এর বাইরে ছায়াপথ মিল্কিওয়ের অসংখ্য সোলার সিস্টেমের কোনো গ্রহে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ- একটি মাইলফলক, স্বপ্নময় অভিযাত্রার সূচনা। এটি আমাদের সবার জন্যই গর্বের। আর এ কর্মকান্ডের সূচনাতে আমার একটা ভূমিকার কথা ভেবে আমি বিশেষ কৃতার্থ ও গৌরববোধ করি ব্যক্তিগতভাবে সবিনয়ে।
প্রশ্ন: আশা করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু-১ এর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ স্যাটেলাইট
ব্যান্ডউইথের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি একদিকে যেমন দেশি টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার খরচ কমে আসবে, অন্যদিকে এ বাবদ বিদেশে মোটা অঙ্কের টাকা চলে যাওয়াটাও বন্ধ হবে। আপনি এই কর্মযজ্ঞকে কীভাবে দেখছেন?
উত্তর: তুমি যে আশা ব্যক্ত করেছ তা আমারও আশা।স্যাটেলাইট টিভিগুলো বিদেশি স্যাটেলাইট কোম্পানিসমূহকে ভাড়া হিসেবে বর্তমানে বার্ষিক প্রায় ১৪ লক্ষ ডলার দেয়, যে বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের দেশেই থেকে যাবে। এটি দেশের অগ্রগতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, দেশের মর্যাদা বাড়াবে।
প্রশ্ন: স্যাটেলাইটের অরবিটাল লোকেশনের কারণে বঙ্গবন্ধু-১ সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ব্যাংকক, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকাসহ আরো অনেক দেশে সরাসরি সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনায় কারিগরি বাধায় পড়বে বলে বলা হচ্ছে। আপনার মত কি?
উত্তর: আমাদের তো এখন স্যাটেলাইট হতে যাচ্ছে প্রাথমিকভাবে একটি -‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। একটি স্যাটেলাইট দিয়ে তো সব এলাকায় পরিসেবা দেয়া সম্ভব নয়। সে সব অঞ্চল এ উপগ্রহের আওতার বাইরে। তবে অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথেচুক্তির মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কমিউনিকশন কোম্পানি’ সে ব্যবস্থা করতে পারবে বলে আশা করা যায়। আর আরও যে' দু'টি উপগ্রহ (বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ ও ৩)-এর চিন্তা করা হচ্ছে সে'গুলো বাস্তবায়ন হলে তো এরকম কোনো সমস্যাই থাকবে না ।
প্র্রশ্ন: আমাদের স্যাটেলাইটের কারিগরি সুবিধা ও অসুবিধা বিষয়ে বলবেন কি?
উত্তর:স্যাটেলাইট যোগাযোগ পাহাড় পর্বত, বন-জঙ্গল, উচু স্থাপনা কোনো কিছুতেই বাধাগ্রস্ত হয় না। এজন্য সমগ্র বাংলাদেশের স্থল ও জলসীমায় নিরবিচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার নিশ্চয়তা দেবে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। এছাড়াও এর বিস্তীর্ণ আওতা এলাকায়- ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও মধ্য এশিয়ার অন্তর্ভূক্ত এলাকায় পরিসেবা দিতে পারবে। এর ট্রান্সপন্ডার এন্টিনা সর্বাধুনিক মানে নির্মিত। তবে যেমনটা বলেছি, একটি মাত্র উপগ্রহের পরিসেবা-আওতা প্রাথমিকভাবে চাহিদামতো বিস্তৃত থাকবে না। এজন্য কিছু ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন পড়বে।
প্রশ্ন: কী ধরনে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে?
উত্তর: অন্য স্যাটেলাইট কোম্পানিগুলোর সাথে আন্ত:চুক্তি করে এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে।
প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের কক্ষপথের একটি সীমাবদ্ধতারবিষয় আলোচনা হচ্ছে। আসলে আমাদের জন্য কোনো অরবিটাল লোকেশনটি ভালো?
উত্তর:কল্পবিজ্ঞানী আর্থার সি ক্লার্কস-এর নামে ক্লার্কস্ অরবিট বা অরবিট জিও স্টেশনারি অরবিট- এ বা স্থান সিমীত। যে স্থান আমাদের দিক থেকে আদর্শ স্থান হতে পারতো সেখানে তো অন্য সংস্থার উপগ্রহ কার্যকর রয়েছে। আর বরাদ্দ দেয়ার এখতিয়ার তো একমাত্র আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ সংস্থা-আইটিইউ-এর। সব সীমাবদ্ধতা মিলিয়ে ৯০ ডিগ্রি পূর্ব-দ্রাঘিমাংশের যত কাছাকাছি সম্ভব তা পাবার চেষ্টা করা হয়েছে। আইটিইউ আমাদের ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের আরও কাছের স্থান বরাদ্দ করতে পারেনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১৯৯৮-৯৯ যখন প্রথম স্যাটেলাইট প্রকল্প নেয়া হয়েছিল, তাতে যদি ২০০১ সালে বাধা না পড়তো তবে আমরা আরও অধিকতর সুবিধাজনক স্থান পেতাম;আর ভাড়া নেয়া বাবদ, তাও আবার মাত্র ১৫ বৎসরের জন্য, রাশিয়াকে প্রদত্ত ২১৯ কোটি টাকাও লাগতো না। যাহোক, বর্তমান অবস্থানটি একটু তীর্যক হলেও এবং সর্বোত্তম না বলা গেলেও এটিকে বর্তমানে ‘সম্ভব সর্বোত্তম’ বলা হবে অবশ্যই।
প্রশ্ন: আমাদের স্যাটেলাইট ব্যান্ডউইডথ চাহিদা কতটুকু? বঙ্গবন্ধু-১ এর কতটুকু চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে?
উত্তর:৪০টি ট্রান্সপন্ডার সম্বলিত ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এর ক্যাপাসিটি যথেষ্ট বড়। এগুলোর মধ্যে ২৬টি কেইউ এবং ১৪টি সি ব্যান্ডের। এর ২০টি ট্রান্সপন্ডার আমাদের স্যাটেলাইট ব্যান্ডউইডথ চাহিদা পুরোপুরি মেটাতে সক্ষম হবে। আর বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডারের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করাও সম্ভব হবে।
প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধু-১ কী ব্যান্ডইউডথ অর্থের অপচয় কমাতে পারবে? কীভাবে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার ও সুফল নিশ্চিত করা যেতে পারে?
উত্তর:অবশ্যই আশা করা যেতে পারে। বিদেশ থেকে যেন ব্যান্ডউইডথ কিনে দেশের অর্থের অপচয় না হয় সেটা এই স্যাটেলাইটের অন্যতম লক্ষ্য। এর সর্বোচ্চ ব্যবহার ও সুফল নিশ্চিত করতে হলে এর পরিচালনা কোম্পানি- বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন কোম্পানির পরিচালনা দক্ষ হতে হবে। এর কারিগরি পরিচালনায় যেমন দক্ষতা থাকতে হবে, তেমনি এর ব্যবসায়িক দক্ষতা, এর বাজার সন্ধান, প্রচার ও বিপণনে খুবই গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রশ্ন: কবে থেকে বঙ্গবন্ধু-১ সাটেলাইট থেকে আমরা সুবিধা পেতে শুরু করবো?
উত্তর: গত ৩০ মার্চ বঙ্গবন্ধু-১ ফ্লোরিডা লঞ্চিং প্যাডে পৌঁছেছে। প্রাথমিকভাবে এর সম্ভাব্য উৎক্ষেপণ ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর, নির্ধারণ করা হয়। পরে চলতি বছরের ৩০ মার্চসহ আরও নানা তারিখ বলা হয়। তারপর আগামী ৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের সময় বিকেল পাঁচটায় স্যাটেলাইটটিকে মহাকাশের উৎক্ষেপ করার কথা বলা হলেও পরে তা পরিবর্তন হয়ে ৭ মে সম্ভাব্য তারিখ ঠিক করা হয়। সেটিও পিছোতে পারে কিছুটা। উৎক্ষেপণের পর প্রথমে তো দুই তিন সপ্তাহ লেগে যাবে একে ক্লার্কস্ অরবিটের সুনির্দিষ্ট স্থানটিতে নিয়ে সুনির্দিষ্ট আবর্তন গতিতে রাখতে। এর পরও প্রায় মাস খানেক পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলবে। এরপর বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম শুরু করতে পারবে। অর্থাৎ সব ঠিক ঠাক থাকলেও বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট থেকে সুবিধা পেতে আগস্ট মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।
প্রশ্ন: আগামীতে আইপিটিভি কী স্যাটেলাইট টিভির বিকল্প হবে বলে মনে করেন?
উত্তর: আইপি টিভি ও আইপি রেডিও’র ব্যবহার প্রসারমান। তবে তা স্যাটেলাইট টিভির ঠিক বিকল্প হয়ে স্যাটেলাইট টিভিকে সরিয়ে দেবে না। যেমন ১৯২০-৩০ এর দশকে প্রথম যখন বেতার সম্প্রচার সম্প্রসারিত হতে থাকলো কেউ কেউ মনে করলেন এটি পত্র-পত্রিকাকে হটিয়ে দেবে কিংবা পরবর্তী সময় যখন টেলিভিশন সম্প্রচার আরম্ভ হলো, তখন রেডিও সম্প্রচার সম্বন্ধেও একই সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে পত্র-পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশনসবই সমাজে জনপ্রিয় থাকছে। এক এক প্রযুক্তির এক এক আকর্ষণ। একক সুবিধা। তবে নতুন মাধ্যম এলে দেখা যায়, আগের মাধ্যম নতুন পরিস্থিতিতে কিছু নতুন নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। অভিযোজন করে। আইপি মাধ্যমে বেশ কিছু সুবিধা থাকলেও এর ব্যান্ডউইডথের সীমাবদ্ধতা জনিত অসুবিধা হয়তো থাকবে। বিলম্বের (delay) বিষয় থাকবে। আমি ধারণা করি, ভবিষ্যতে সব টেলিভিশন ও বেতার সম্প্রচারকারী সংস্থা একইসাথে স্যাটেলাইট টিভি ও রেডিও চালাবে, একই স্টুডিও ব্যবস্থা থাকবে।