লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৮ - সেপ্টেম্বর
ডিজিটাল বৈষম্যে নারী ও গ্রাম
ডিজিটাল বৈষম্যে নারী ও গ্রাম
ইমদাদুল হক
ডিজিটাল রেনেসাঁর দেশ বাংলাদেশ। জনঘনত্বে বিশ্বের অন্যতম এ দেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রতি তীব্র আকর্ষণ। অক্ষর জ্ঞানে পটু না হয়েও এখানকার ৭২ শতাংশ মানুষের রয়েছে অন্তত একটি করে মুঠোফোন। তারপরও দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ইন্টারনেট বিষয়ে অজ্ঞ। দেশের মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে ১১ শতাংশ ব্যবহারকারীর আবাস গ্রামে। আর শহরে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ১৯ শতাংশ মানুষ। আসলে মোবাইল ফোন ব্যবহারে এগিয়ে থাকলেও যথেষ্ট স্মার্ট করা যায়নি এর ব্যবহারকারীদের। আমদানির মাধ্যমে সহজলভ্যতার সাথে সাথে দেশেই স্মার্টফোনের উৎপাদন শুরু হলেও এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা কিন্তু সমান হারে বাড়ছে না। বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষণ বলছে, ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রযুক্তি বিপ্লবের মৌলিক অনুষঙ্গ স্মার্টফোন ব্যবহারে বৈষম্য কিন্তু কমছে না। প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে আমাদের অবস্থা কিছু কিছু সূচকে আশা-জাগানিয়া হলেও সেলফোন ব্যবহারের মুন্সিয়ানা কিংবা লাগসই ব্যবহারে পিছিয়ে রয়েছে প্রান্তিক মানুষ। ব্যবহারে নারী-পুরুষ অসমতার পাশাপাশি নগর-গ্রামে দূরত্বটাও কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে শহর-গ্রাম ও নারী-পুরুষের যে বৈষম্যের দায় খুঁজতে গিয়ে মোটা দাগে দেখা গেছে, কেনার সামর্থ্য না থাকা এবং সচেতনতার অভাবেই এ বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত দেশে মোট সক্রিয় মোবাইল ফোন সংযোগের সংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ২৫ লাখ ২৭ হাজার। এর মধ্যে ৭ কোটি ২৩ হাজার গ্রাহক রয়েছেন গ্রামীণফোনের। এয়ারটেলকে পকেটে পুরে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রবির গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৩০ হাজার। অপর দুই অপারেটরের মধ্যে বাংলালিংকের ব্যবহৃত সিমের সংখ্যা ৩ কোটি ৩৭ লাখ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর টেলিটকের গ্রাহক মাত্র ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার। ৯০ দিনের মধ্যে ভয়েস, ডাটা ও এসএমএসের যেকোনো একটি সেবা চালু থাকার শর্তে নিরুপিত এই পরিসংখ্যান আপাত দৃষ্টিতে দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় অভাবনীয় একটি বিষয় মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। অবশ্য একটু গভীর মনোনিবেশে ভাবনার উদ্রেক করে। এই যেমন চতুর্থ প্রজন্মের (৪জি) মোবাইল তরঙ্গ সেবা চালুর পর আমরা যখন পঞ্চম প্রজন্মে প্রবেশের স্বপ্ন বুনছি, তখনও ফিচার ফোনেই আটকে আছেন দেশের ৮২ শতাংশ ব্যবহারকারী। আবার মোবাইলে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে ৮ কোটি ২৯ লাখ ১২ হাজার। পরিসংখ্যান বলছে, জুলাই পর্যন্ত দেশের মোট সক্রিয় ইন্টারনেট সংযোগ সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ৮৬ লাখ ৮৭ হাজার। এর মধ্যে ৫৬ লাখ ৯১ হাজার সংযোগ ইন্টারনেট সেবাদাতা ও পিএসটিএনের মাধ্যমে এবং শহরকেন্দ্রিক তারহীন প্রযুক্তির ইন্টারনেট সেবা ওয়াইম্যাক্স অপারেটরদের সংযোগ সংখ্যা মাত্র ৮৪ হাজার।
এদিকে শ্রীলঙ্কাভিত্তিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) পলিসি এবং রেগুলেশন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক লার্ন এশিয়া প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, মোবাইল ডিভাইস, বিশেষ করে স্মার্টফোন এখন বিভিন্ন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের ডিজিটাল সেবা ব্যবহারের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানোয় গ্রামীণ মানুষেরাও স্মার্টফোনের মতো মোবাইল ডিভাইস দিয়ে ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রবেশের সুবিধা পাচ্ছেন। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০৭ সালে উন্নত ফিচার নিয়ে বাজারে আসে আইফোন। এরপর থেকেই বিশ্বজুড়ে স্মার্টফোনের জয়যাত্রা শুরু। নানা কারণে বিশ্বজুড়ে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছেই। ২০১৭ সালে বিশে^ স্মার্টফোন ব্যবহারকারী ছিল প্রায় ২৩০ কোটি। চলতি বছরে এই সংখ্যা কমে যাবে, তা ভাবার কোনো যুক্তি নেই। কারণ, কমপিউটারের প্রায় সব কাজই মুঠোয় পুরে ফেলেছে স্মার্টফোন। বিশেষ করে পৃথিবীর অনুন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলোয় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই যন্ত্র।
সঙ্গতভাবেই ডিজিটাল বাংলাদেশের ৭২ শতাংশ মানুষের হাতেই এখন মোবাইল ফোন রয়েছে। অবশ্য এর মধ্যে ২৪ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে স্মার্টফোন। কিন্তু মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ এখনো ইন্টারনেটের সাথে পরিচিত নয়। এখানে গ্রামের চেয়ে শহরে ৭ শতাংশ বেশি মানুষ সেলফোন ব্যবহার করছেন। গ্রামের সেলফোন ব্যবহারকারীদের ১৮ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখানে শহরের ৭৮ শতাংশ এবং গ্রামের ৭২ শতাংশের হাতে একটি করে সেলফোন রয়েছে। ব্যবহারকারীদের বয়স ১৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। মজার বিষয়, সেলফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ আয়-রোজগারের দিক দিয়ে সচ্ছল এবং ৭৩ শতাংশ অসচ্ছল হলেও ৫৪ শতাংশের কোনো আয় নেই।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় (এশিয়া প্যাসিফিক) অঞ্চলের ডিজিটাল-বৈষম্য নিয়ে গত ৭ আগস্ট প্রকাশ করা হয় এ গবেষণা প্রতিবেদনটি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় মোবাইল ফোন ব্যবহারের এরূপ বৈষম্য বাড়ছে। বিভিন্ন দেশে শহর অঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ মানুষেরা মোবাইল ফোন ব্যবহারে পিছিয়ে রয়েছেন। ভারতে শহর ও গ্রামীণ মানুষের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারের পার্থক্য ২২ শতাংশ। আশার কথা, প্রতিবেশী এই দেশটিতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে পার্থক্য তা আমাদের দেশ থেকেও বেশি। একইভাবে স্বল্পোন্নত দেশ পাকিস্তান ও কেনিয়ার চেয়েও বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেনিয়ায় নগর ও গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারের পার্থক্য ৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এ পার্থক্য যথাক্রমে ৭ ও ৫ শতাংশ।
আমাদের গৌরবের বিষয়, ২০২০ সালের মধ্যে ডিজিটাল রূপকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া উদ্যোগের পর ডিজিটাল সেবা ছড়িয়ে দিতে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার উদ্যোগ নেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ২০১৮-১৯ সালের মধ্যে শতভাগ টেলিডেনসিটি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে এ উদ্যোগ পাঁচ বছরে পদার্পণ করেছে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না জেনে সংশোধিত মেয়াদ ২০২২ সাল পর্যন্ত নির্ধারিত করা হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে প্রকাশিত লার্ন এশিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতে টেলিযোগাযোগ সেবা গ্রাহকদের ৫৫ শতাংশ বেসিক ফিচার ফোন ব্যবহার করছে। অর্থাৎ এসব ফোন দিয়ে ইন্টারনেটে প্রবেশের সুযোগ নেই। দেশটির টেলিযোগাযোগ সেবা গ্রাহকের ১৬ শতাংশ ফিচার ফোন এবং ২৮ শতাংশ স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। জরিপে অংশ নেয়া ১৫-৬৫ বছর বয়সী ৬৫ শতাংশ ভারতীয় জানিয়েছে, তারা জানে না ইন্টারনেট কী এবং ৮১ শতাংশ দাবি করে, তারা কখনো ইন্টারনেট ব্যবহার করেনি।
প্রসঙ্গত, ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমিউনিকেশনস বা ডিওটির ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, ডিজিটাল ইন্ডিয়া ক্যাম্পেইনের আওতায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং ব্রডব্যান্ড সংযোগের গ্রাহক বাড়াতে জোর দেয়া হচ্ছে। ২০১৭ সালের জুনের হিসাব মতে, দেশটিতে ইন্টারনেট সংযোগ ৪৩ কোটি ১২ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে নগর অঞ্চলে ২৯ কোটি ৩৮ লাখ এবং গ্রামীণ অঞ্চলে ১৩ কোটি ৭৩ লাখ ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতভিত্তিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান কান্তার আইএমআরবির তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ভারতের নগর অঞ্চলে ইন্টারনেট পেনিট্রেশন ৬৪ দশমিক ৮৪ শতাংশে পৌঁছেছে, যা এক বছর আগের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশটির গ্রামীণ অঞ্চলে ইন্টারনেট পেনিট্রেশন ২০ দশমিক ২৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০১৬ সালের শেষে ১৮ শতাংশ ছিল। নগর ও গ্রামীণ অঞ্চলের ইন্টারনেট পেনিট্রেশন প্রবৃদ্ধির হার থেকে স্পষ্ট হয়, ভারতে ডিজিটাল বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে।
প্রতিবেশীর দিক থেকে এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক ডিজিটাল জীবশৈলীর দিক থেকে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের দিকে। লার্ন এশিয়া জানাচ্ছে, বাংলাদেশে সেলফোন ব্যবহারকারীদের ৪০ শতাংশ বেসিক ফোন এবং ৩৭ শতাংশ ফিচার ফোন ব্যবহার করেন। এখানে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর হার ২৪ শতাংশ। মোবাইল ফোনের মালিকানায় শহর ও গ্রামের হার ২৭ ও ২২ শতাংশ। পরিসংখ্যানভিত্তিক এই গবেষণায় ১ হাজার ৫৩১ জন সেলফোন ব্যবহারকারীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, মোট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ নারী ও ৩৮ শতাংশ পুরুষ ফিচার ফোন ব্যবহার করেন। অন্যদিকে ২৫ শতাংশ পুরুষ ও ২০ শতাংশ নারী স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৮৭.৪ শতাংশ পুরুষের হাতে যেখানে সেলফোন রয়েছে, সেখানে নারীর হার ৫৭.৬ শতাংশ। একইভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১৮.২ শতাংশ পুরুষ হলেও নারীর হার অর্ধেকেরও কম। মাত্র ৭ শতাংশ। অবশ্য স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অনুপাতে নারী-পুরুষের ব্যবধান খুবই কম। ১৩ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ২৫.৫ শতাংশ পুরুষ। পক্ষান্তরে ২০.৩ শতাংশ নারী। বর্তমানে দেশে মোবাইল ফোনের মালিকানায় নারী-পুরুষ বৈষম্যের হার ৩৪ শতাংশ।
লার্ন এশিয়া জানাচ্ছে, ক্রয় সামর্থ্য না থাকা, মোবাইল কাভারেজ না থাকা, ঘরে মোবাইল ফোন চার্জ দেয়ার মতো বৈদ্যুতিক সুবিধা না থাকা এবং কীভাবে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে হয় তা না জানার কারণে বিশে^র অনেক দেশেই ডিজিটাল বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে এশিয়ার ৪টি দেশের পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে সংস্থাটি। দেশ ৪টি হলো বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়া। এই পরিসংখ্যান গ্রাফ চিত্রে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৩৪.৬ শতাংশ মানুষের স্মার্টফোন কেনার সক্ষমতা নেই। স্মার্ট মোবাইল কাভারেজের বাইরে রয়েছেন ১৭.৪ শতাংশ মানুষ। বৈদ্যুতিক সমস্যায় স্মার্টফোন চার্জ দেয়ার সমস্যায় আক্রান্ত ১৯.১ শতাংশ। আর ব্যবহারকারীদের ২৭.৪ শতাংশ মানুষ জানেন না কীভাবে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে হয়। সমস্যার আরও গভীরে গিয়ে সংস্থাটি জানাচ্ছে, বেসিক ফোন ব্যবহারকারীদের ৬৬ শতাংশ, ফিচার ফোন ব্যবহারকারীদের ৬৪ শতাংশ ও স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের ৬১ শতাংশই ইন্টারনেট কীভাবে ব্যবহার করেন তা জানেন না। যারা ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে ১ শতাংশ বেসিক ফোনে, ৫ শতাংশ ফিচার ফোনে ও ৬৪ শতাংশ স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
একইভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারে বাধা হিসেবে ৬৬.৫ শতাংশ ইন্টারনেট কী তা না জানার বিষয়টি এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ৫.১ ভাগ ব্যবহারকারী জানেনই না স্মার্টফোনে কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়। একইভাবে ৭.১ ভাগের ইন্টারনেটে সংযুক্তির মতো স্মার্টফোন/কমপিউটার নেই। ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না এমন ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮ শতাংশেরই এ নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। তারা মনে করেন, ইন্টারনেট ইউজফুল নয়। আর সবচেয়ে বড় অংশ, অর্থাৎ ৬৪ শতাংশের অভিমত ইন্টারনেট ব্যবহার খুবই ব্যয়বহুল একটি বিষয়। ইন্টারনেট থেকে ভাইরাস ও ম্যালওয়্যার ভীতিতে ৩০ শতাংশ ইন্টারনেট থেকে দূরে থাকেন। ১৯ শতাংশ পারিবারিক ও অভিভাবকের বাধার কারণে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। ১৫ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট না থাকার কারণে ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহী নয়। তবে ৩৬ শতাংশই ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারণে ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহী নয়। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ওপর দৈব চয়ন ভিত্তিতে পরিচালিত লার্ন এশিয়ার এই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৪৮ শতাংশ মানুষ শুধু অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুঁদ হয়ে থাকেন। শুধু স্মার্টফোন নয়, বেসিক ও ফিচার ফোনেও ফেসবুক ব্যবহার করেন।
ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৬২ শতাংশ স্মার্টফোনে এবং ৪ ও ২ শতাংশ যথাক্রমে ফিচার ও বেসিক ফোনে ফেসবুক ব্যবহার করেন। তারপরও অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে দেশে নারী-পুরুষের আনুপাতিক ব্যবধান ৬৬ শতাংশ। ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১৮ শতাংশ পুরুষ সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করলেও এখানে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৬ শতাংশ। ধর্ম, রাজনীতি এবং লৈঙ্গিক কারণে এই মাধ্যমটিকে এড়িয়ে চলেন এবং এখানকার খবরে আস্থা রাখেন না। এছাড়া গ্রাম ও শহরের মধ্যে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের বৈষম্য ব্যবধান ৪০ শতাংশ। এখানে শহর-গ্রাম বৈষম্য অনুপাত ১৮:১। পরিসংখ্যান বলছে, বিবিধ কাজে ১৯ শতাংশ, খবর পড়তে ১১ শতাংশ এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ ও ৫ শতাংশ বিনোদনের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। বাকি ৭ শতাংশ দাফতরিক কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। আর নিজেদের মধ্যে টেক্সট চ্যাটিং করতে ৯৩ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন। এছাড়া এ মাধ্যমটিতে পরিবার ও বন্ধুর সাথে সংযুক্ত থাকেন ৯৪ শতাংশ, ৮১ শতাংশ ভয়েস কল করেন, ৮৬ শতাংশ ভিডিও কল করেন। আর ৭৬ শতাংশ নতুন বন্ধু তৈরি করতে এই মাধ্যমটি ব্যবহার করেন। একইভাবে ৭৩ শতাংশ এই নেটওয়ার্ক থেকেই খবর পড়েন। মজার বিষয় হচ্ছে, এদের ৫৩ শতাংশই এখানকার খবর একেবারেই বিশ^াস করেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পঠিত খবরের ওপর বিশ^াস রাখেন ২৩ শতাংশ। আর প্রবলভাবে এসব খবরকে গ্রহণ করেন ৩ শতাংশ। যদিও ১৩ শতাংশের ততটা আস্থা নেই এবং ৮ শতাংশ খবর আমলে নেন না। ৩৩ শতাংশ ব্যবহারকারী এই মাধ্যমটিতে রাজনৈতিক অভিব্যক্তি শেয়ার করেন।
এদিকে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে অ্যাপ ব্যবহার বিষয়েও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশে বেশিরভাগ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীই ফেসবুক ব্যবহার করলেও অ্যাপের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া তথা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, টুইটার, লিকডইন ও লাইন ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র ১৯ শতাংশ। এক্ষেত্রে এশিয়ায় শীর্ষে থাকা ভারতের হার ৪৮ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে লিখিত ফরম্যাটে বার্তা বিনিময়ের জন্য অ্যাপ ব্যবহারকারীর শতকরা হার ২২ শতাংশ। পরিসংখ্যানটি বলছে, অ্যাপ ব্যবহারকারীদের মধ্যে দেশের ১৩ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বিনোদনের ক্ষেত্রে অ্যাপ ব্যবহার করেন। একই হারে অ্যাপের মাধ্যমে গেম খেলেন। আর কথা বলতে ১৭ শতাংশ ব্যবহারকারী হোয়াটসঅ্যাপ, স্কাইপে, ভাইবার, লাইন ও টক-রে অ্যাপ ব্যবহার করেন। অ্যাপ থেকে পছন্দের পোর্টাল থেকে খবর পড়েন ৮ শতাংশ। ডিকশনারি ও শিক্ষাবিষয়ক লার্নিং অ্যাপ ব্যবহার করেন ৮ শতাংশ। অনুসন্ধানবিষয়ক অ্যাপ যেমন ম্যাপস, ডিরেকশন, ফোন নম্বর ইত্যাদির জন্য অ্যাপ ব্যবহার করেন ৭ শতাংশ। ক্যালকুলেটর, কনভার্টার ও ট্রান্সেলেটরের মতো বিজনেস অ্যাপ ব্যবহার করেন ১৫ শতাংশ। এর বাইরে ৩ শতাংশ ওয়েদার অ্যাপ, ৩ শতাংশ ই-কমার্স অ্যাপ এবং ২ শতাংশ ট্রান্সপোর্ট অ্যাপ ব্যবহার করেন।
আশাপ্রদ বিষয় হলো, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ই-ব্যবসায়ের প্রসারে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জরিপ বলছে, ই-লেনদেনের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে এখানে ২৭ শতাংশ মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করেন। আর ৩ শতাংশ মোবাইল মানি থেকে লেনদেন করেন। এখানে ২৪ শতাংশ কাপড়, প্রসাধনী ইত্যাদি কেনাবেচা করেন মোবাইলে। ২৩ শতাংশ টিকেট কাটতে কিংবা ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্ট ও ফি দেন এই মাধ্যমটিতে। ১৯ শতাংশ পরিবহন সেবার মূল্য পরিশোধ করেন। ১৬ শতাংশ ফ্রিল্যান্সিং কাজের লেনদেন এই মাধ্যমটিতেই সম্পন্ন করেন। কিন্তু বেচাকেনার ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশ মোবাইল ব্যবহারকারী এই মাধ্যমটির প্রয়োজন বোধ করেন না। ১৯ শতাংশ জানেনই না কীভাবে মোবাইলের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করতে হয়। জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের নগরীর বাইরে বিপুলসংখ্যক মানুষের হাতে প্রযুক্তি থাকলেও এর টেকসই ব্যবহার যেমন হচ্ছে না, তেমনি একটি টেকসই ও স্থিতিশীল বাণিজ্যিক মডেল না থাকায় ভেতরে ভেতরে ডিজিটাল বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। মোবাইল ব্যবহারে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও নারীদের সম্পৃক্ততা আরও বাড়ানো গেলে এই খাতটিকে ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনীতি সহজেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে বলে মনে করেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট আরও সহজলভ্য এবং এর বৈচিত্র্যময় ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তারা