লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
করজালে ই-প্রযুক্তি খাত
চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে করজালে জড়িয়ে পড়েছে দেশের বিকাশমান ই-কমার্স খাত ও পরিবহনভিত্তিক অ্যাপ সেবা। অন্যদিকে আমদানি করা মোবাইল ফোন, চার্জার, ব্যাটারির ওপর শুল্ক বাড়ানো হলেও দেশে উৎপাদিত ফোনে মূসক প্রত্যাহারের আগাম বার্তা দেয়া হয়েছে। আর বহুল আলোচিত ইন্টারনেটের ওপর থেকে কর প্রত্যাহারের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।
প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ
২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ বেড়েছে এক হাজার ১৬২ কোটি টাকা। অপরদিকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে গত বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে এক হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। প্রস্তাবনার তুলনায় টেলিকম ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ কমেছে ৪৩৫ কোটি টাকা। তবে গত অর্থবছর থেকে বরাদ্দ বেড়েছে এক হাজার ১২৮ কোটি টাকা বেশি।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য ১২ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে দুই হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। টেলিকম ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন এবং সুরক্ষায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে দেয়া হয় তিন হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা।
গত ৭ জুন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আগামী অর্থবছরে এই বাজেট বরাদ্দ ঘোষণা করেন। এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগকে এককভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তিন হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে তিন হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা পেয়েছিল।
আর একই অর্থবছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত বাজেট ছিল নয় হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। অবশ্য প্রস্তাব করা হয়েছিল ১১ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। তখন সংশোধিত বাজাটে এক হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা পেয়েছিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।
প্রসঙ্গত, ২০১৮-১৯ বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ এবং টেলিযোগাযোগ বিভাগ মিলিয়ে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল ছয় হাজার ৬৪ কোটি টাকা।
এবারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ বাজেট বাস্তবায়নে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেমন শিক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ বাড়ানোর লক্ষ্যে জেলা পর্যায়ে চলমান বিজ্ঞানবিষয়ক ক্যুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন বৃদ্ধি ও উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষণাধর্মী কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে খুলনা, বরিশাল, রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটারের শাখা স্থাপনের কাজ শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এছাড়া বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজন বৃদ্ধি ও বিষয়ভিত্তিক বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদকে (বিসিএসআইআর) একটি সেন্টার অব এক্সিলেন্স ও সেন্টার ফর টেকনোলজি ট্রান্সফার অ্যান্ড ইনোভেশন হিসেবে রূপান্তর করা হচ্ছে।
একই সাথে পারমাণবিক নিরাপত্তার পাশাপাশি পারমাণবিক বিকিরণ হতে সুরক্ষার লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অবকাঠামো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
করজালে ই-ব্যবসায় ও অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা
চলতি বছরের বাজেটে ইন্টারনেটনির্ভর ব্যবসায় ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আরোপ এবং ফেসবুক, ইউটিউবের মতো প্রতিষ্ঠান এবং অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবাকে করের আওতায় আনা হয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বর্তমান ইন্টারনেট বা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয় বেড়েছে। এই পণ্য বা সেবার পরিসরকে আরও বাড়াতে ভার্চ্যুয়াল বিজনেস নামের আরেকটি সেবার সংজ্ঞা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর ফলে অনলাইনভিত্তিক যেকোনো পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তরকে এই সেবার অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে। এ সময় ভার্চ্যুয়াল ব্যবসায় সেবার ওপর ৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপের প্রস্তাব করেন তিনি।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন এবং ভার্চ্যুয়াল ও ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশের কারণে আন্তঃসীমান্ত লেনদেনের ধরন ও আকারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের অর্থনীতি এখন অনেক বেশি উন্মুক্ত। ফলে কর পরিহারের ঝুঁকিও বেশ বেড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটে বলা হয়েছে, ‘ভার্চ্যুয়াল ও ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে প্রচুর আয় করছে, কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমরা তেমন একটা কর পাচ্ছি না। ভার্চ্যুয়াল ও ডিজিটাল লেনদেনের বিষয়টি তুলনামূলক নতুন বিধায় এসব লেনদেনকে করের আওতায় আনার মতো পর্যাপ্ত বিধান এতদিন আমাদের কর আইনে ছিল না। ভার্চ্যুয়াল ও ডিজিটাল খাত যেমনÑ ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব ইত্যাদির বাংলাদেশে অর্জিত আয়ের ওপর করারোপের জন্য আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে প্রয়োজনীয় আইনী বিধান সংযোজনের প্রস্তাব করা হলো। এছাড়া কর ব্যবস্থাকে আধুনিক ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক করার অনেক উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে এই অর্থবছর হতে করদাতাকে ই-মেইলে নোটিশ প্রেরণের বিধান কর আইনে সংযোজন করার প্রস্তাব করা হয়।
একইভাবে বাজেটে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং ভাড়ার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। উৎসে করের আওতায় আনা হয়েছে এই সেবাদাতা রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে। আর এসব সেবায় যারা যানবাহন দেবেন তাদের টিআইএন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাজেট বক্তব্যে বলা হয়েছে, বর্তমানে ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পণ্য বা সেবার পরিসরকে আরও বাড়াতে ভার্চ্যুয়াল বিজনেস নামে একটি সেবার সংজ্ঞা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর ফলে অনলাইনভিত্তিক যেকেনো পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তরকে এ সেবার আওতাভুক্ত করা সম্ভব হবে। তাই ভার্চ্যুয়াল বিজনেস সেবার ওপর ৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৫-১৬ বাজেট ঘোষণায় ই-কমার্সকে প্রথমবারের মতো সুনির্দিষ্ট করে ভ্যাটের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তখন ই-কমার্সে ভ্যাটের হার ৪ শতাংশ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দাবিতে অর্থমন্ত্রী এই খাতকে শৈশব সময় ধরে ভ্যাট প্রত্যাহার করেন। এরপর দুই অর্থবছরে এই খাতে আর ভ্যাট আরোপ করা হয়নি।
বাড়ল প্রযুক্তিপণ্যের আমদানি শুল্ক
এবারের বাজেটে প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনমুখিতার বেশ কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মোবাইল ফোনের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে ২৪ শতাংশ পর্যন্ত। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি, লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারি, ভাইব্রেটর, মোটর, রিসিভার, এয়ারফোন বাটন, বিভিন্ন যন্ত্রাংশের কাভার, ইউএসবি ও ওটিজি ক্যাবলসহ ৪৪টি উপকরণে শুল্ক কমানো হয়েছে। আগে এসব উপকরণে ৫, ১০, ১৫ ও ২৫ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক ছিল। এখন ৪০টি উপকরণে তা ১ শতাংশ করা হয়েছে। আর বাকি চারটিতে ১০ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে।
একই সাথে দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন বা সংযোজনের জন্য বিভিন্ন উপকরণ আমদানিতে এই রেয়াতি সুবিধা দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবে বিদেশ থেকে আমদানি করা ১০ ভোল্টের নিচে বিভিন্ন ধরনের মোবাইল ফোন ও ব্যাটারি চার্জার, ২০০০ ভোল্ট পর্যন্ত ইউপিএস, আইপিএস, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারের আমদানি শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সাথে স্বয়ংক্রিয় সার্কিট ব্রেকার ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করারও প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে দেশে মোবাইল ফোন ও ব্যাটারি চার্জারের দাম আগামী অর্থবছর থেকে বাড়তে পারে। তবে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ও লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারি আমদানির ওপর থেকে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু ব্যাটারি নয়, বাজেটে দেশে সেল্যুলার ফোন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কতিপয় কাঁচামালের ওপর থেকে শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে মোবাইল ফোনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে মোবাইল ফোন সেটকে উৎপাদন পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি সুবিধা দিয়ে একটি আলাদা প্রজ্ঞাপন জারির প্রস্তাব করছি। এ ছাড়া স্থানীয় মোবাইল উৎপাদনের ওপর সারচার্জ অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করে মোবাইল সেট আমদানি পর্যায়ে ২ শতাংশ সারচার্জ আরোপের প্রস্তাব করছি।’
অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী দেশে যদি মোবাইল ফোন উৎপাদনের কারখানা বা কার্যক্রম চালানো হয়, তবে উৎপাদন পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে মোবাইল ফোন উৎপাদন করলে সারচার্জ অব্যাহতি মিলবে। তবে আমদানি পর্যায়ে ২ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হলে বিদেশ থেকে আমদানি করা ফোনের দাম বেড়ে যেতে পারে।
গুরুত্ব শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরে
বাজেটে শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাজেট বক্তৃতার ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, সৃজনশীল ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারে সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এসব পরিকল্পনার মধ্যে ই-বুক, বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ‘আইসিটি ট্রেনিং অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার’ স্থাপনসহ বিভিন্ন ডিজিটাল কার্যক্রম নেয়া হয়েছে।
ই-বুক প্রচলনের পাশাপাশি ১২৫টি উপজেলায় ‘আইসিটি ট্রেনিং অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আরও ১৬০টি উপজেলায় এটি প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলছে। ৩১৫টি উপজেলায় একটি করে বেসরকারি বিদ্যালয়কে মডেল বিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়েছে, ২৬ হাজার ৬৫৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ৯০ হাজার শিক্ষক এবং ১৫০০ মাস্টার ট্রেনারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। টিচার্স পোর্টালে ৬২ হাজার কনটেন্ট তৈরি করা হয়েছে, যা ব্যবহার করে শিক্ষকেরা নিজেরাই কনটেন্টের মানোন্নয়ন করতে পারছেন।