লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
লেখার ধরণ:
ডিজিটাল বাংলাদেশ
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন কি সিলিকন বর্জ্যের দেশ!
প্রথমে পুরনো কমপিউটার ব্যবসায়ীদের একটি দল সদ্যবিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের মগজ ধোলাই করার চেষ্টা করেছিল। তারা তাকে প্রাথমিকভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল, বাংলাদেশের স্বল্প ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষকে কমপিউটারসমৃদ্ধ করতে হলে আমাদের প্রয়োজন হবে পুরনো কমপিউটার আমদানি করা। তখন তিনি বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে তাদের মতামত দিতে বললে মন্ত্রণালয় সেটি বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলে পাঠায়। কমপিউটার কাউন্সিল বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির কাছে মতামত জানতে চাইলে আমরা লিখিতভাবে জানাই, পুরনো কমপিউটার আমাদের জন্য সুবিধার হবে না, বরং আমরা বিপজ্জনক সিলিকন বর্জ্যের দেশে পরিণত হব। কিন্তু তাতেও প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেমে থাকেনি। তারা বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বিবেচনা করতে বলে। পরে আইসিটি টাস্কফোর্সের এক সভায় প্রধান উপদেষ্টা প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলে আমি বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করি এবং তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুরনো কমপিউটার আমদানিতে আর পদক্ষেপ নেয়নি।
গত ১৩ ও ২৭ জুলাই যুগান্তর পত্রিকার পাতায় আবার সেই পুরনো প্রসঙ্গ। ১৩ জুলাইয়ের শিরোনাম : ‘‘উন্নত বিশ্বের স্টকলট : ৬ থেকে ৮ হাজার টাকায় কমপিউটার।’’ তরিক রহমান, সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এসে এ রিপোর্ট করেন। খবরটি এমন : ‘‘বাংলাদেশে পুরনো কমপিউটারের বাজারটা তৈরি হলে সাধারণ মানুষের কাছে মাত্র ৮-১০ হাজার টাকায় কমপিউটার পৌঁছানো যেত।’’ বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছে, সেটা কি শুধু শহুরে মানুষদের জন্য। গ্রামের মানুষদের হাইকনফিগারেশনের কমপিউটার কেনার সামর্থ্য নেই। অথচ আমরা কেজি দরে, ৭ ডলার বা ৩৫০ টাকায় প্রতিকেজি মাদারবোর্ড বিক্রি করি। ১ গিগাহার্টজ প্রসেসর, ২০ গি.বা. হার্ডডিস্ক, ডিভিডি রম, নেটওয়ার্ক কার্ড, সাউন্ডকার্ড ও সিআরটি মনিটরসহ এই পেন্টিয়াম-থ্রি মানের আইবিএম, এইচপি, ডেলসহ মূল ব্র্যান্ডের কমপিউটার সিঙ্গাপুরে ৩ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। অপরদিকে ২ গিগাহার্টজ প্রসেসর, ৫১২ রম, ডিভিডি/সিডি প্লে¬য়ার, হার্ডডিস্ক ৮০ গি.গা., সাউন্ডকার্ড, নেটওয়ার্ক কার্ডসহ পেন্টিয়াম-ফোর মানের ব্র্যান্ডের কমপিউটার সিআরটি মনিটরসহ পাওয়া যাবে মাত্র ৬-৭ হাজার টাকায়। আর এলসিডি মনিটরসহ পাওয়া যাবে ১০-১১ হাজার টাকায়। সব মিলিয়ে ১ হাজার টাকা খরচ হবে শিপমেন্টে। একজন সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্য এসব কমপিউটার কি যথেষ্ট নয়?
সিঙ্গাপুরের অনাবাসী বাংলাদেশী, স্টকলট ব্যবসায়ী মো: আসাদুজ্জামান ফিটুর বরাত দিয়ে এমন কথাগুলো যুগান্তরের প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়।
আসাদুজ্জামানের মতোই আরো কয়েকজন; হাবিবুর রহমান ও আবুল কালামের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদক মন্তব্য করেন, ‘‘সরকারের কতিপয় মহল নতুন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে এই কমপিউটারগুলোকে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। অথচ সিঙ্গাপুর থেকে এই কমপিউটারগুলো যাচ্ছে আফ্রিকার তানজানিয়া, মাদাগাস্কার, দুবাই, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, মিসরসহ প্রায় ৩০টি দেশে। সিঙ্গাপুর থেকে প্রতি কন্টেনারে ৪০০ কমপিউটার ধরে এমন ২শ’ থেকে ৫শ’ কন্টেনার কমপিউটার প্রতিমাসে আমদানি-রফতানি হচ্ছে।’’ আমি অবাক হয়েছি এজন্য যে, আমি নিজে নতুন কমপিউটার আমদানিকারকদের সমিতির সভাপতি এবং আমার জানামতে আমার সমিতি বা আমার কোনো সদস্য বা অন্য কোনো ব্যবসায়ী কারসাজি করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আমি কামনা করি, তরিক রহমান সেই কারসাজিকারী মহলটির নাম প্রকাশ করবেন। আমি আরো অবাক হয়েছি, দেশগুলোর তালিকায় দুবাইয়ের নাম রয়েছে। কারণ, ওখানে বাংলাদেশের গরিব মানুষেরাই কি এসব কমপিউটার কেনে? এমন প্রশ্ন উঠতে পারে।
এরপর প্রতিবেদক মন্তব্য করেছেন, পুরনো কমপিউটার নাকি আমদানি নিষিদ্ধ। আমি অবাক হয়েছি তার জ্ঞানের বহর দেখে। কারণ পুরনো কমপিউটার মোটেই আমদানি নিষিদ্ধ নয়। বরং বলা যায় এর আমদানি শর্তসাপেক্ষ ও নিয়ন্ত্রিত। তবে এর অবস্থা প্রায় নিষিদ্ধ হবার মতো। কেননা, আমদানিকারকরা পুরনো কমপিউটার আমদানির অতিসাধারণ শর্তগুলো পূরণ করতে পারেন না। বাস্তবতা হলো : বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের অনুমতি নিয়ে পুরনো কমপিউটার আমদানি করা যায় এবং এই তথ্যগুলো কমপিউটার কাউন্সিলের ওয়েবসাইটেই দেয়া আছে। বিসিসি’র ওয়েবসাইটটির ঠিকানা হলো : http://www.bcc.net.bd/application_used_training.pdf। তরিক রহমানের খবরের কাটিং নিয়ে এরই মাঝে কয়েকজন কমপিউটার কাউন্সিলে যোগাযোগও করেছেন এবং তাদেরকে বিসিসির ওয়েবসাইট অনুসারে কাগজপত্র দাখিল করে পুরনো কমপিউটার আমদানির পরামর্শও দেয়া হয়েছে।
পত্রিকাটির প্রতিবেদনে এরপর পুরনো কমপিউটারের গুণকীর্তন করা হয়েছে যার মর্মকথা হলো এগুলো সস্তা। এরপর প্রতিবেদক কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সাথে কথোপকথনের বিবরণ দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথোপকথন : ‘‘দেশে ফিরে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময়ে উঠে এসেছে স্টকলট কমপিউটারের পক্ষ-বিপক্ষের অভিমত। এশিয়ান ওশেনিয়ান কমপিউটিং অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ এইচ কাফি বলেন, যে দেশে মাছের সাথে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে, ফলের সঙ্গে বিষাক্ত কেমিক্যাল, ওষুধের মধ্যে ভেজাল, সে দেশে পুরনো কমপিউটার আনতে দিলে সেটা নতুন বলে বিক্রি হওয়া শুরু হবে। ফলে অসাধুতার জন্যই সম্ভব হবে না সুফল অর্জন করা। আবার কেউ কেউ বলছিলেন ই-বর্জ্যের কথা।’’ আবদুল্লাহ এইচ কাফির এ মন্তব্য প্রকাশের পর প্রতিবেদক নিজেই মন্তব্য করেন, ‘‘এর পাল্টা যুক্তিতে বলা যায়, যে দেশে সড়কপথের তুলনায় অধিকহারে রিকন্ডিশনড গাড়ি আসতে পারে, সেদেশে প্রয়োজন মেটাতে কেনো রিকন্ডিশনড কমপিউটার আসতে পারবে না।’’ মন্তব্যকারীর জন্য এটি বলা দরকার, এদেশে কোনোকালেই রিকন্ডিশনড কমপিউটার আসার কোনো প্রস্তাবই পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া গেছে, সেটি হলো পুরনো ও ব্যবহৃত কমপিউটার, যা যে অবস্থায় আছে তাই। কাকতালীয়ভাবে সম্প্রতি বিসিসিতে যে ভদ্রলোক পুরনো কমপিউটার আমদানির অনুমতি চাইতে গিয়েছিলেন তিনিও একই যুক্তি দিয়েছেন। তবে বিসিসি তাকে বলেছে যে, গাড়িতে বিপজ্জনক মার্কারি-অক্সাইড নেই- কিন্তু কমপিউটারে আছে- পার্থক্যটি এখানেই।
২০০২ সালের ইউএসএ টুডে পত্রিকার একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না।
সেই ওয়েব ঠিকানাটি হলো : http://www.usatoday.com/tech/news/2002/02/25/computer-waste.htm.
এতে বলা হয়েছে : Much toxic computer waste lands in Third World, SAN JOSE, Calif. (AP) - What happened to that old computer after you sold it to a secondhand parts dealer? Environmental groups say there's a good chance it ended up in a dump in the developing world, where thousands of laborers burn, smash and pick apart electronic waste to scavenge for the precious metals inside - unwittingly exposing themselves and their surroundings to innumerable toxic hazards.
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০২-এর এই পত্রিকাটির পুরো প্রতিবেদনটি লোমহর্ষকভাবে আমাদের মতো দেশে সিলিকন বর্জ্য ডাম্প করার কাহিনী বিধৃত করে। আমি জানি অনন্য রায়হান অনেক পড়াশোনা করেন এবং ইন্টারনেটও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। তিনি এসব তথ্য কেন নজরে আনলেন না- সেটি আমার বোধগম্য নয়। প্রসঙ্গত, তিনি ইউরোপ ও আমেরিকার পুরনো কমপিউটারবিষয়ক আইনকানুনগুলো পাঠ করতে পারেন।
খবরটি ছাপার আগে তরিক রহমান আমার সাথে ফোনে দু’বার কথা বলেছিলেন। আমি আমার প্রতিক্রিয়া তাকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আরও কয়েকজনের মন্তব্য ছাপলেও এই খবরের সাথে আমার মন্তব্যটি ছাপেননি। খুব সঙ্গত কারণ আছে এর। আমি তার মন্তব্য বা মতামতের তীব্র বিরোধিতা করেছিলাম। যেহেতু আমার মন্তব্য তার খবরের পক্ষে নয় সেজন্য তরিক রহমান আমার মতামতটি গায়েব করে দিয়েছিলেন। খবরটি পাঠ করে আমি এর প্রতিবাদ করায় এবং দৈনিক জনকণ্ঠে একটি মন্তব্য ছাপা হওয়ায় ২৭ জুলাইয়ের যুগান্তর ডটকমে সেই খবরটির ফলোআপ হিসেবে আরও একটি বড় স্টোরি ছাপা হয়, যাতে আমার একটি ছোট সাক্ষাৎকারও অতি নিরীহ ও গুরুত্বহীনভাবে ছাপা হয়। অথচ এই খবরটির গ্রন্থনাকারী হিমুকে আমি চিনিই না। তিনি কী করে আমার সাক্ষাৎকার পেলেন সেটি আমি জানি না। আমি তার সাথে কোনো কথা বলিনি। আমি কথা বলেছি তরিকের সাথে। কিন্তু ২৭ জুলাইয়ের খবরে তরিকের কোনো ভূমিকাই নেই। যাহোক এতে আমার পুরো বক্তব্যের চুম্বক অংশটুকুও রাখা হয়নি। আমি বুঝতে পারছি যে, সাক্ষাৎকার গায়েব করার অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবার জন্য তরিক রহমানের এই প্রচেষ্টা।
এদিন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ, আক্তারুজ্জামান মঞ্জু, হাবিবুল্লাহ এন করিম, কাওসার আহমেদ ও মাহমুদুর রহমানের মন্তব্য ছাপা হয়। আগের সংখ্যার মতামতের চাইতে এবারের মতামতগুলোর তেমন কোনো ভিন্নতা নেই। বরং বলা যায়, সবই তরিক রহমানের বক্তব্যের পক্ষেরই। আমি লক্ষ করেছি অনেককে স্টকলট বিষয়টি আগ্রহী করেছে। কিন্তু তারা ১৩ জুলাই ২০০৯ সংখ্যায় ছাপা হওয়া স্টকলটের নামে পুরনো কমপিউটারগুলোর ছবির কথা সম্ভবত স্মরণ রাখতে পারেননি। এমনকি আরো একবার তথাকথিত স্টকলট (অবিক্রীত নতুন কমপিউটার) কমপিউটারের পক্ষে আরো একহাত নিয়েছেন। কিন্তু তিনি একবারও এই কথাটি বলেননি যে, দুনিয়ার কোনো দেশ কার্যত কোনো স্টকলট কমপিউটার বিক্রি করে না- তারা পুরনো এবং ব্যবহৃত কমপিউটার ডাম্প করে। এতে কমপিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমানের মতামতও আছে। সেটি পাঠ করলে মনে হয়, নির্বাহী পরিচালক তার নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড সম্পর্কেও অবহিত নন।
যাহোক, আমি মনে করি, তরিকের প্রতিবেদনের একটি সঠিক জবাব দেয়া অতি প্রয়োজন। তরিক লিখেছেন, উন্নত বিশ্বের ‘স্টকলট’ বাংলাদেশ আমদানি করতে পারে। কার্যত তিনি খবরটির ভেতরে যা লিখেছেন তা হলো : ব্যবহৃত বা পুরনো কমপিউটার। স্টকলট ও পুরনো কমপিউটার এক জিনিস নয়। আমরা স্টকলট হিসেবে তাকেই বুঝি, যা নতুন ও কোনো কারণে বিক্রি হয়নি। আমাদের দেশের গার্মেন্টস শিল্পে এটি হরহামেশা ঘটে। কিন্তু পেন্টিয়াম-৩ বা ৪ ব্র্যান্ডেড পিসির কথা এখানে বলা হয়েছে। এটি সত্যিই বিভ্রামিত্মকর। এ ধরনের পিসির এখন আর স্টকলট হবার যোগাড় নেই।
এবার দেখা যাক, পুরনো কমপিউটারের মাজেজাটি কী? তরিকের খবর অনুসারে সিঙ্গাপুর থেকে পেন্টিয়াম-৩ চার হাজার (এক হাজার টাকার শিপিং খরচসহ) পেন্টিয়াম-৪ মানের কমপিউটার ৭-৮ হাজার এবং এলসিডি মনিটরসহ ১১-১২ হাজার টাকায় আমদানি করা যেতে পারে। তিনি কেজি দরে মাদারবোর্ড-হার্ডডিস্ক ইত্যাদি বিক্রির কথাও খবরে উল্লেখ করেছেন। আমরা যদি প্রকৃত অবস্থা যাচাই করি তবে দেখবো, কমদামী হওয়া সত্ত্বেও পেন্টিয়াম-৩-এর বয়স হবে কমপক্ষে সাত বছর। কারণ, ছয় বছর আগে ২০০৩ সালে পেন্টিয়াম-৩ বানানো বন্ধ হয়ে গেছে। পেন্টিয়াম-৪-এর বয়স হবে তিন বছর। কারণ, ২০০৮ সালের আগস্টের পরে ইন্টেল পেন্টিয়াম-৪ প্রসেসর শিপমেন্ট করেনি। যদিও সময়টি এক বছরের, তবুও কার্যত দুই বছরের আগে কেউ কমপিউটার ফেলে দেয় না। ফলে পেন্টিয়াম-৪ কমপিউটারের বয়স তিন বছরের কম হবে না। সেই সময় থেকেই কমপিউটারপ্রযুক্তি কোর টু ডুয়ো বা ডুয়াল কোরে পা দিয়ে অতীতকে বাতিল করে দিয়েছে।
প্রসেসরের বয়স বা আমাদের গ্রামের মানুষের কাজের চাহিদার দিক থেকে বিচার করলে পেন্টিয়াম-৩ বা ৪ মোটেই অগ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, কমপিউটারের মাইক্রোপ্রসেসর খুব সহজে নষ্ট হয় না। কমপিউটারের মাদারবোর্ড নিয়েও তেমন কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কমপিউটারের কেসিং, হার্ডডিস্ক, পাওয়ার সাপ্লাই এবং মনিটরকে কোনোভাবেই দুই বছরের পরে নির্ভর করার মতো অবস্থায় পাওয়া যায় না। বরং হার্ডডিস্ক, পাওয়ার সাপ্লাই বা মনিটর তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম বছরে পৌঁছালে তাকে একদিনের জন্যও বিশ্বাস করা যাবে না। আরও দুঃখজনক, পুরনো হার্ডডিস্কগুলোর নতুন স্পেয়ার এখন আর উৎপাদিত হয় না। এমনকি সিআরটি মনিটরও এখন আর উৎপাদিত হয় না। পাওয়ার সাপ্লাই বা কেসিং নতুন কেনা ছাড়া গতি নেই। কেসিংয়ের দাম গড়ে দুই হাজার টাকা। হার্ডডিস্কের দাম পড়বে সাড়ে তিন হাজার টাকা। মনিটর কিনতে গেলে অন্তত সাত-আট হাজার টাকা লাগবে।
আমি নিশ্চিতভাবে একথা বলতে পারি, এসব পুরনো কমপিউটারে অন্তত ছয় মাসের মাঝেই কোনো না কোনো অংশ বদলাতে হবে। ফলে তরিক রহমানের দামের সাথে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা ছয় মাসেই যোগ হবে। এমনকি কপাল মন্দ হলে এতে আট-দশ হাজার টাকাও যোগ হতে পারে। এর সাথে আমদানিকারক তার মুনাফা এবং আমদানি ব্যয় যোগ করলে প্রতিটি কমপিউটারে কমপক্ষে আরও দুই হাজার টাকা যোগ হবে। এবার হিসেব করে দেখুন পুরনো কমপিউটারের দাম কততে দাঁড়াবে।
স্মরণ করিয়ে দিতে পারি, দেশের বাজারে একেবারে নতুন কমপিউটার কিনতে ১২ হাজার টাকা লাগে। এর সাথে এক বছরের ওয়ারেন্টি পাওয়া যায়। যদি তরিক রহমান এলিফ্যান্ট রোডে যান তবে দেখবেন, ছয় হাজার টাকায় বাংলাদেশের পুরনো কমপিউটার কেনা যায়। আমার কাছে এমন দামে বিক্রির অফার দেবার ভিডিও ধারণ করা আছে। যেকেউ ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে এমন অফার পাবেন। দিনে দিনে আমাদের নিজেদের পুরনো কমপিউটারের সংখ্যা বাড়ছে এবং সেসবের রিসাইক্লিং করার প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে। এমন অবস্থায় আমরা নিজেদের ঘরের পুরনো কমপিউটারের বদলে বিদেশের টক্সিক ওয়েস্ট কেনো আমদানি করব। একসময়ে আমাদের নিজেদের সিলিকন বর্জ্যই তো বিপদ তৈরি করবে। সেজন্য বরং এখনই আমাদের বর্জ্য নীতিমালা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করা দরকার।
তরিক রহমান গাড়ির সাথে তুলনা করেছেন। আমরা পুরনো গাড়ি আমদানি করি বলে আমাদের কোনো ক্ষতি হয় না, কমপিউটারে হবে কেনো? এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, একটি গাড়ির আয়ু আমি নিজে ২৬ বছর করতে পেরেছি। এর জন্য আমাদের ধোলাইখাল আছে যেখানে আমরা স্পেয়ার বানাতে পারি। আমি আমার ১৯৮১ মডেলের একটি গাড়িকে ২০০৭ সালে ধোলাইখালে পাঠাই। আমি এখন যে গাড়িটি চালাই সেটি ১৬ বছর যাবত চলছে। কিন্তু একটি নতুন কমপিউটারকে দুই বছরের বেশি চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। এর র্যালম, হার্ডডিস্ক, পাওয়ার সাপ্লাই বা মনিটর কোনোভাবেই দুই বছরের বেশি নির্ভরযোগ্য থাকে না। এসব স্পেয়ার আমাদেরকে কে বানিয়ে দেবে? ফলে পুরনো কমপিউটার আমদানির অর্থ হলো, নিজের দেশটিকে সিলিকন বর্জ্যের দেশে পরিণত করা। পৃথিবীর সব উন্নত দেশ সিলিকন বর্জ্যকে অন্যতম ভয়াবহ ও বিপজ্জনক বর্জ্য হিসেবে মনে করে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ কার্যত বিপুল পরিমাণ অর্থ এই বর্জ্য সামাল দিতে ব্যয় করে থাকে। আমেরিকার অনেক রাজ্য এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করার জন্য কঠোর আইন রয়েছে।
তরিক রহমানকে আমি জানাতে চাই, তিনি তো বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুরনো কমপিউটার কিনতে বলেছেন- আর আমরা বিনামূল্যে এসব কমপিউটার পাবার অফার হাতে নিয়ে বসে আছি। অস্ট্রেলিয়া আমাদেরকে অফার দিয়েছে যে তারা আমাদেরকে কমপিউটার তো দান করবেই এমনকি শিপিং চার্জও দেবে, যদি আমরা নিয়মিত পুরনো কমপিউটার আনতে চাই। অস্ট্রেলিয়ার কমপিউটার বাজারজাতকারীরা নিজেরা অর্থ ব্যয় করে পুরনো কমপিউটার আইনানুগভাবে পরিবেশ রক্ষায় নষ্ট করে থাকে। সেখানকার সিটি কর্পোরেশনগুলো পুরনো কমপিউটার ফেরৎ দিলে ব্যবহারকারীকে পয়সা দেয়। আমরা কি সেই ফাঁদে পা দেবো?
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com